টার্মিনালে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে, ঘাটে ভিড়িয়ে রাখা বিশাল কোনো সামুদ্রিক জাহাজের ছাদ। রেলিং ধরে এক লাইনে চলে গেছে সারি সারি নৌকা। গাছপালা দিয়ে ঘেরা অতিথিদের বসার জায়গা। রোদ হোক বা বৃষ্টি, কোনো আবহাওয়ায় যেন সমস্যা না হয়, তার জন্য বেশ উঁচু করে দেওয়া ছাউনি। সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার ছাদে বসেই সারতে পারবেন অতিথিরা। একেবারে বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা রেস্তোরাঁটির নাম ‘বুড়িগঙ্গা রিভারভিউ রেস্টুরেন্ট’। জাহাজের ছাদের মতোই বিশাল এই রেস্তোরাঁর অবস্থান ঢাকার সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিএ টার্মিনাল
১৭ জুলাই বিকেলে সদরঘাটের ভিড় ঠেলে টার্মিনাল ভবন ২-এর শেষ গেট দিয়ে বেরোতেই চোখে পড়ল ঝলমলে মরিচবাতিতে সাজানো রেস্তোরাঁর প্রবেশপথ। লিফট দিয়ে ওপরে উঠে গেলেই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বসার জায়গা। সেখানে না বসে খোলা ছাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছাদজোড়া এই রেস্তোরাঁর কূলকিনারা খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছিল। আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন রেস্তোরাঁর হেড আব অপারেশন মিজানুর রহমান।
তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ছাদে উঠে গেলাম। আলাপে আলাপে জানা গেল, ২৪ হাজার বর্গফুট ছাদের পুরোটাই রেস্তোরাঁ। নদীর দিকে চোখ পড়তেই দেখি, সূর্য হেলে পড়েছে। রেস্তোরাঁয় ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। এই ভিড় নাকি কিছুই না, বলছিলেন মিজানুর রহমান। শুক্র ও শনিবার নাকি হাঁটার উপায় থাকে না। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রায় ৬০০ লোকের একসঙ্গে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা আছে। তাই বিয়ে, জন্মদিন, পুনর্মিলনী ইত্যাদি বড় আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারব। এ ছাড়া দাপ্তরিক বৈঠক কিংবা মিটিং রুমে অফিসের কাজ করার মতো পরিবেশ আছে।’
ঘরের কাছে হওয়ায় সময় পেলেই অবসর কাটাতে এখানে চলে আসেন পুরান ঢাকা থেকে আগত অতিথি ব্যবসায়ী জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা কিংবা পরিবার নিয়ে খেতে যাওয়ার জন্য এই রেস্তোরাঁর তুলনা হয় না। রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের আচরণের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘যেকোনো সমস্যাই তাঁরা খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখেন, সমাধান করেন।’
ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে চোখে পড়ল রেলিংয়ের কাছের একটি টেবিলে বসে স্ত্রী হালিমা খাতুনের সঙ্গে নদীর দিকে তাকিয়ে সূর্যাস্ত দেখছেন আলাউদ্দিন মোল্লা। তিনি জানান, আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে এমনই কোনো এক বিকেলে নদীর ঘাটে এসেছিলেন তিনি। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে অনেক দিন পর ফিরে এসে অত্যন্ত আনন্দিত তিনি। স্মৃতি রোমন্থন করে আলাউদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘সব বদলে গেছে; জীবন বোধহয় এমনই।’ সত্যি! নদীর রূপ বদলেছে, ঘাটের চিত্র বদলেছে, কোলাহলেও এসেছে পরিবর্তন। তা ছাড়া পদ্মা সেতু হওয়ার পর থেকে টার্মিনালে ভিড়ও আগের চেয়ে এখন অনেকটাই কম। ঘাটে বাঁধা সারি সারি লঞ্চ, যাত্রীর জন্য জাহাজিদের হাঁক, আর তার পেছনে বিস্তৃত বুড়িগঙ্গা নদী। সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে এসব দৃশ্য উপভোগ করতে চাইলে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কীইবা হতে পারে?
এর মধ্যেই সূর্য ডুবতে শুরু করেছে, ঘনিয়ে আসছে আঁধার। ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে রেস্তোরাঁর বাতিগুলো। বুড়িগঙ্গার তীরে ভেসে থাকা লঞ্চগুলোও আলোঝলমল করে ওঠে তখন। এ সময় এই জায়গা এত বেশি মায়াবী রূপ ধারণ করে যে তা সরাসরি না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
এখানে সব রকমের দেশি খাবার ছাড়াও ভারতীয়, চীনা ইত্যাদি বিদেশি খাবার রান্নার জন্য রয়েছে দেশ-বিদেশ থেকে আগত প্রায় ৩০ জন রাঁধুনি। মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রায়ই আমাদের আরবীয় খাবারগুলোর প্রশংসা পাওয়া যায়। এ খাবারগুলো যাঁরা রান্না করেন, তারা দীর্ঘদিন আরবে রাঁধুনির কাজ করে এসেছেন।’
প্রতিদিনই সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত এই রেস্তোরাঁর মেনু দেখে মনে হলো, খাবারের দাম বেশ পরিমিত। তা ছাড়া শিক্ষার্থী এবং চাকরিজীবীদের জন্য রোববার থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে ৩৬০ টাকায় খাবারের সঙ্গে পানীয় এবং কর সবকিছু অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মিজানুর রহমান বলেন, ‘ছোটরাসহ সবাই যেন আসতে পারেন, এ জন্য এমন ব্যবস্থা।’